শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পদ্মা সেতু

রায়হান আহমেদ তপাদার:
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই নদীগুলো একদিকে যেমন আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমির রূপ দিয়েছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগকে করেছে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার সংযুক্তি ঘটাতেই নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে অনেক সেতু। যমুনার ওপরে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু, গড়াই নদীতে লালন শাহ সেতু, মেঘনায় রয়েছে বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী সেতু-১, ব্রহ্মপুত্র ও বুড়িগঙ্গায় আছে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল প্রমত্ত পদ্মার বুকে একটি সেতু। যা বর্তমান সরকারের ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে আজ কোটি কোটি মানুষের সেই স্বপ্ন বাস্তবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ।

পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন দেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অর্জন, যা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, সব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে ও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগকে পেছনে ফেলে ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে সেই স্বপ্ন এখন একেবারে তীরে ভেড়ার অপেক্ষায়। দূরত্ব কমে যাবে দেশের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের। এর সঙ্গে অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে দ্রুত বেগে। অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখবে দেশের দুই ভাগকে এক করা পদ্মা সেতু। বাড়বে জীবনযাত্রার মান। পদ্মা সেতু নতুন বার্তা পৌঁছে দেবে দেশ এবং দেশের বাইরে। সেতুটি চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ। নতুন করে গড়ে উঠবে ভারী শিল্পকারখানা। আর এরই অপেক্ষায় যেন বাংলাদেশ। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে। এডিবির সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে যে ২৪ হাজার যানবাহন চলবে, তার মধ্যে বাস চলবে ৮ হাজার ২৩৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। সমীক্ষায় আরও প্রাক্কলন করা হয়েছে,২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫। ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮০৭টি। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষামতে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে।

এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গে শিল্পায়নের গতি ব্যাপক বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অসামান্য অবকাঠামোগুলোর একটি। ধীরে ধীরে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই স্তরবিশিষ্ট পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রায় ৬৩ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এবং দক্ষিণ পশ্চিমের জনগণের অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়নশীল এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, জীবনমানের উন্নয়ন ও জ্ঞান-মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির বিকল্প নেই। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার। তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় উন্নয়নের ধারক ও বাহক স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রজন্মের কিংবদন্তি, তারুণ্যের বাতিঘর ও বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের শেষ আশ্রয়স্থল দেশরতœ শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এখন আর কেবল স্বপ্নই নয়, বাস্তব।

বাংলাদেশ এখন আত্মবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা বহুমুখী সেতু। যেখানে সড়ক ও রেল উভয় মাধ্যমেই সংযোগ স্থাপিত হবে এবং এর মাধ্যমে দেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর বিপ্লব সাধিত হবে। পদ্মা সেতুর নানান অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন দিক থেকেই এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল ও অধিকতর চাঙ্গা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিদৃষ্ট হবে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ অবশ্যই দেশের জন্য এক অকল্পনীয় ঘটনাই বটে!

যদিও পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একমাত্র মেগা প্রকল্প নয়, এর আগেও এদেশে বহু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে পদ্মা সেতুর বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এই সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ কারও কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেনি। এটি আমাদের আত্মগৌরবের জায়গাটিকে মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। যে দেশে সত্তরের দশকেও শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থা ছিল তলাবিহীন ঝুড়ির মতো, সেই দেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং এর সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে, এটা গৌরববোধ ও আভিজাত্যের অনন্য অহংকার। বিশ্ব বাংলাদেশকে যে চোখে দেখত, এখন সেই চোখে দেখার দিন ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশ। প্রতিটি অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে চলেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ মানুষ ছিল হতদরিদ্র। আর বর্তমানে বাংলাদেশে দরিদ্রতার হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ; যা ২০১৫ সালেও ছিল ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার। যা নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সুনিশ্চিতভাবেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে। পদ্মা সেতু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগসূত্র স্থাপন করবে। বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী নয়। অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে আছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। এই অঞ্চলে কৃষিপণ্য উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু যোগাযোগ সমস্যার কারণে দরিদ্র কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে। তাই আমরা বলতে পারি, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনে যেমন ভূমিকা রাখবে, অন্যদিকে কৃষকরা আরও অধিক হারে উৎপাদন করবেন।

দক্ষিণাঞ্চলে অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে, যা ভ্রমণপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে থাকে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার অনুপযোগিতার কারণে মানুষের কাছে অনাগ্রহের বিষয় ছিল। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এখন তা নাগালের মধ্যে চলে আসবে। এসব পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে তা থেকেও রাষ্ট্র প্রচুর অর্থ আয় করতে সমর্থ হবে। নানা দিক বিবেচনায় আমরা নিঃসংকোচে বলতে পারি, স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের অনাগত স্বপ্ন পূরণে সারথির কাজ করবে। এ দেশ নিজের অর্থায়নে এত বিশাল সেতু নির্মাণ করতে পারলে, ধীরে ধীরে আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিজ অর্থেই সম্পন্ন করতে পারবে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের জাতীয় মনোবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নিতান্তই একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু নয়। বিশ্বের সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত দ্বিস্তরের এ দৃষ্টিনন্দন সেতুটি একটি দেশের জনগণের হৃদয়মথিত আবেগের নাম। স্বপ্ন পূরণে একটি বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়ণের নাম। এটি সহজেই অনুমেয়। গোটা জাতি প্রস্তুত হচ্ছে এ ইতিহাসের সাক্ষী হতে, এক অনন্য গৌরবের অংশীদার হতে। পদ্মা সেতুর রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মতো একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের সততা, দেশপ্রেম, দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার সাক্ষী হয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে যুগ থেকে যুগান্তরে দাঁড়িয়ে থাকবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়।

বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিভিন্ন সামাজিক সূচকের ক্রম উন্নতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থে করার কারণে বাংলাদেশের সক্ষমতার স্বীকৃতি মিলেছে। আমরা পারি। আমরা সক্ষম। আমাদের মেধা আছে। আমাদের জ্ঞান অন্যদের চেয়ে কম নয়। এই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার কাছে অতুল্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে স্থাপনে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ভালো কিছু করতে পারে এবং বাংলাদেশ এখন একটি সক্ষম দেশ এটা প্রমাণিত হয়েছে।

লেখক গবেষক ও কলামিস্ট/raihan567@yahoo.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION